মার্কিন ডলার ও ভূ-রাজনীতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায়নের পিছে মার্কিন ডলার মার্কিন সেনাবাহিনীর মতই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ইরান, রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এবং প্রতিষ্ঠানের উপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক নিষেধাজ্ঞা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বিষয়টি দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই ক্ষমতার উত্থান একদিনের হয়নি। সেই গল্প শুরু করতে হলে ফিরে যেতে হবে অনেক অতীতে যখন টাকার বিপরীতে স্বর্ণ মজুত থাকতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইওরোপীয় রাষ্ট্র যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে বিপুল অংকে ঋণ গ্রহণ করে এবং সেই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে মুদ্রার বিপরীতে স্বর্ণের মজুদ অনেক কমে যায়। ফলে স্বর্ণ ভিত্তিক মুদ্রা ব্যাবস্থা ধরে রাখা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৪ সালে আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ার এর ব্রেটন উড এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।  এই চুক্তি অনুযায়ী একমাত্র মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ মজুদ থাকবে (প্রতি আউন্সে ৩৫ ডলার) এবং বাকি সকল মুদ্রার মান মার্কিন ডলার এর বিপরীতে নির্ধারিত হবে।  এই চুক্তির ফলে আমেরিকা ব্যাতিত  সকল রাষ্ট্রের জন্যে স্বর্ণের মজুদ ডলার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, অন্য কথায় ডলার আন্তর্জাতিক “রিসার্ভ কারেন্সি” বা মজুদ মুদ্রা তে রুপ লাভ করে। একমাত্র ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ ভাঙ্গিয়ে নেয়া সম্ভব।

একই সময়ে মুদ্রা বাবস্থার স্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক লেনদেন সুনিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং যুদ্ধ পরবর্তী সংস্কারের জন্যে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং পুনর্গঠন ব্যাংক (বর্তমান বিশ্ব ব্যাংক) তৈরি হয় যেই দুইটির উপর ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক অধিকার। এর পরে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক বানিজ্যে ডলারের ব্যাবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দুইটি ভিন্ন মুদ্রার লেনদেন হতে থাকে ডলারের মাধ্যমে। ডলারের হাত ধরে মার্কিন আধিপত্যও বিস্তার লাভ করতে থাকে।

তবে ব্রেটন উডস চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট মজুদকৃত স্বর্ণের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার তাদের ছাপাতে হবে যেন স্বর্ণের দাম আউন্সে ৩৫ ডলারে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত ডলার ছাপানোর ফলে স্বর্ণের বিপরীতে ডলারের দাম পড়তে থাকে।

এর প্রেক্ষিতে ডলারের মুল্য ১৯৭১ সালে এসে আউন্সে ২০০ তে পৌঁছে। এরই প্রেক্ষিতে ফ্রান্স তাদের মজুদকৃত ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ দাবি করে বসে। তখন পৃথিবীকে অবাক করে ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট, তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন স্বর্ণের মজুদ ব্যাবস্থা বিলুপ্ত ঘোষণা করে। ফলে মার্কিন ডলার ফিয়াট কারেন্সি তে রুপ লাভ করে, অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে কোন সম্পদ বরাদ্দ নেই। ডলার নিজেই নিজের মুল্যমান।

এই সিদ্ধান্তর ফলে ডলারের ব্যাপক দরপতন ঘটে। ডলারের মূল্য পুনরুদ্ধারে নিক্সন তেল সমবৃদ্ধ দেশগুলোর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে পেট্রো ডলার ব্যাবস্থার প্রচলন করেন। 

ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ডলারের আধিপত্য এতই বিস্তার লাভ করে যে মার্কিন বলয়ের বাহিরে থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাবসা বানিজ্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই কোন রাষ্ট্রকে একক আধিপত্যে একঘরে করে রাখতে পারে।  ডলারের এই সক্ষমতা মার্কিন সামরিক ক্ষমতার থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ।  আফঘানিস্তান এবং ইরাকে অত্যন্ত ব্যায়বহুল যুদ্ধ পরিচালনার পরে ইরান আক্রমন করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি  অনেকে ইরানে মার্কিন সেনাবাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে থাকে। ইতোমধ্যে ঋণে জর্জরিত মার্কিন সরকারের উপর ব্যয় সংকোচনের জন্যে অভ্যন্তরিন চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এই সব সমস্যার সহজ সমাধান অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ইরান প্রশাসনকে পঙ্গু করে দেয়া। কিন্তু ইরানের সাথে ছয় জাতি চুক্তির যৌথ রাষ্ট্ররা পুনরায় অবরোধ আরোপ করতে নাকশ করে। ফলশ্রুতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর একক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ডলার এতই শক্তিশালী যে যুক্তরাষ্ট্র একচ্ছত্র ভাবে ইরানেকে অর্থনৈতিক ভাবে একঘরে করে দেয়। শুধু ইরান নয়, ভেনেজুয়েলা এবং রাশিয়ার ওপরেও এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা সীমিত আকারে আরোপ করা হয়েছে।

ডলারের ক্ষমতায়ন নিয়ে চীন বর্তমানে অনেক সঙ্কিত আছে। বাণিজ্য নির্ভর দেশ হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সিংহভাগ ডলারে সম্পন্ন হয়ে থাকায়  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে খুব দ্রুতই চীনকে একঘরে করে দিতে পারে। এর ফলে চীনের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।  চীন প্রশাসন এই ব্যাপারে অবহিত। তাই তারা দ্রুততার সাথে আন্তর্জাতিক লেনদেন ডলার থেকে ইউয়ান এ রুপান্তর করার চেষ্টা করছে, প্রধানত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েতিভ দেশেগুলোর সাথে। তবে চীনের জন্যে এই পথ এখনও বহু দূর বাকি। তার কারণ

১। যুক্তরাষ্ট্রের মত চীনের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা মুদ্রা সংস্থা নেই।

২। চীনের মুদ্রা ব্যাবস্থা সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীন নয়। চীন সরকারের বা মুদ্রার উপরে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন।

৩। বর্তমান বাজারে  চীনের সরকারি সঞ্চয়পত্রের তারল্য ও বিস্তৃতি এখনও আশানুরূপ নয়, বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মজুদকৃত মুদ্রার মাত্র ১.৫ শতাংশ চৈনিক মুদ্রা বা সঞ্চয়পত্রে জমা করা হয়।

৪। ইউয়ান অপেক্ষা মার্কিন ডলার দিয়ে লেনদেন আরও নিরাপদে, দ্রুততার সাথে এবং কম খরচে সম্পন্ন হয়।

এই সকল সমস্যার সমাধান হতে পারে ডিজিটাল কারেন্সি বা ক্রিপ্টো মুদ্রা। চীন সরকার এই ব্যাপারে জোরেশোরে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। একই চেষ্টা চালাচ্ছে ইরান এবং ভেনেজুয়েলা। অর্থাৎ, মার্কিন প্রশাসনের ভুক্তভোগী রাষ্ট্রসমূহ এই প্রচেষ্টায় সর্বাপেক্ষা এগিয়ে। অপর একটি সমাধান হতে পারে স্বর্ণ। চীন ইতোমধ্যেই তেল বাণিজ্যে স্বর্ণভিত্তিক বন্ড বাজারে এনেছে। তবে কবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মাধ্যম এবং মজুদ মুদ্রা হিসেবে ডলার প্রতিস্থাপিত হবে এবং কি বিকল্প ব্যবস্থা আসছে এবং সেই ব্যাবস্থা কতটা স্বাধীন হবে তার উপর নির্ভর করছে আগামী বিশ্ব।

শেয়ার করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *