আমরা প্রায়ই দেখি আমেরিকা উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অভিযোগ আনে এবং এই সকল উন্নয়নশীল দেশসমূহ বিভিন্নভাবে তার নিজেকে নির্দোশ প্রমাণ করতে চায়।
ব্যাপার হচ্ছে আমেরিকার নিজেরও সমস্যার শেষ নেই। তবে কারো সাধ্য নেই যে আমেরিকার বিরুদ্ধে পালটা অভিযোগ হানবে এবং আমেরিকা কাচুমাচু হয়ে দোষ ঢাকার চেষ্টা করবে। এইটাই হচ্ছে শক্তির খেলা। আমেরিকাকে প্রমাণ করতে হয় না যে সে নির্দোষ, যদিও সে সারা বিশ্বে যুদ্ধ বিগ্রহ করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সে বাদে অন্য দেশগুলোকে প্রমাণ করতে হয় যে তারা যুদ্ধংদোহী না। যদিও আমেরিকা ফ্র্যাকিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তেল উত্তোলন করছে যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, আমেরিকাকে কারো কাছে প্রমাণ করতে হয় যে সে দূষণকারী না বরং আমেরিকার কাছে অন্যান্য দেশকে প্রমাণ করতে হয় যে সে পরিবেশ সুন্দর রাখছে। যদিও আমেরিকা বন্দীদের নির্যাতন করে (আফিয়া সিদ্দিকী, জুলিয়ান এসাঞ্জ, খলিদ শেখ সহ অনেকে), অন্যান্য দেশকেই আমেরিকার কাছে প্রমাণ করতে হয় যে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে না।
এমনকি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপর আমেরিকা যখন মিথ্যা অভিযোগ তুলে আক্রমণ চালালো (ইরাক) তার জন্য আমেরিকাকে কোন অবরোধের সম্মূখীন হতে হয় নাই। কেউ বলে নাই যে, “আমেরিকা, তুমি যা করেছ তা মানবতা বিরোধী, তুমি একটি দেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করেছ, তোমার উপর বাণিজ্য অবরোধ দেওয়া হবে, বিভিন্ন কোম্পানি তোমাকে বর্জন করবে, তোমার সম্পদ ফ্রিজ করা হবে ইত্যাদি।” হয়তো আপানাদের কাছেও পড়তে হাস্যকর লাগছে, কিন্তু এই সবগুলো কাজই আমেরিকা করে যখন অন্য কোন দেশ একই কাজ করে।
কিন্তু কেন আমেরিকা মানবতার ফেরিওয়ালা সেজেছে এবং কেন সারা বিশ্বকে আমেরিকার কাছে প্রমাণ করতে হয় যে সে নির্দোষ? এর মূল কারণ অর্থনৈতিক এবং কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক। উদাহরণস্বরূপ কোন দরিদ্র দেশকে, যার সাথে আমেরিকার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ নেই, প্রমাণ করতে হয় না যে তার দেশে গণতন্ত্র আছে, সেখানে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে না, নারী স্বাধীনতা আছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে ইত্যাদি। কিন্তু যেইমাত্র একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, তার উপর গোয়েন্দা, মানবাধিকার সংস্থা ও সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ঘন ঘন সেই দেশের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট বক্তব্য প্রদান করতে থাকে। জাতিসংঘে তাদেরকে নিয়ে আলোচনা করা হয় ইত্যাদি।
এত কিছুর পরেও পাঠকদের কেউ কেউ যদি মনে মনে ভেবে থাকেন, “আমেরিকা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার ধারক ও বাহক। তাই বিশ্বব্যাপী শৃঙ্খলা রক্ষার নিমিত্তে আমেরিকা যেই রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে, তা অতিমাত্রায় সন্দেহের চোখে দেখা উচিত না।” তাদের উদ্দেশ্যে বলছি – আমেরিকার সাথে যেই দেশগুলো হাত মেলায়, যেমন সৌদি আরব, মিশর, আমিরাত তাদের দেশের স্বৈরাচারতন্ত্র নিয়ে আমেরিকা কখনও বিরুপ মন্তব্য করে না। এমনকি সৌদি আরবে মহিলাদের অধিকার প্রশ্নেও আমেরিকার সরকার নিরব। আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সৌদি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে কোন রিপোর্ট পেশ করে না, কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ইরানে মহিলাদের কোন অধিকার খর্ব হলে আমেরিকার সরকার প্রধান থেকে মিডিয়া, এক্টিভিস্ট থেকে একাডেমিশিয়ান সকলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। একই বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে। ভারতের কোম্পানিগুলো আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী না। বরং মার্কিন কোম্পানি গুলো দাবানলের মত ভারতের বাজারে বিস্তার করছে। এজন্য আমরা দেখি উইঘুর মুসলিমদের অধিকারের ব্যাপারে আমেরিকার সরকার এবং মিডিয়া অত্যন্ত সচেতন হলেও কাশ্মীর ইস্যুতে তারা বরফের মত শীতল। ভারতের সাথে সম্পর্ক টানাপোড়ন হলে এই ব্যাপারে কিছুটা গুঞ্জন উঠে কিন্তু আমেরিকার দাবী মেনে নিলে সেই গুঞ্জন আবার থেমে যায়। কাশ্মীর ইস্যু ছাড়াও ভারতের অভ্যন্তরে মুসলিম নিধন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ দূষণ সহ অন্যান্য ইস্যুতে কখনও পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত “আন্তর্জাতিক” মিডিয়ার আলোচনা করে না, সেই তুলনায় কল্পনা করুন পাকিস্তানের কোন এক গ্রামে এমন ঘটনা ঘটেছে; যেমন – মালালাকে গুলি করা হয়েছে। তাকে কি পরিমাণ নজর কাড়ানো হয়েছে সবার। এক কথায় সেই সকল রাষ্ট্রকে আমেরিকা বাগে আনতে চায় তাদের দেশে নারীরা কতটা অধিকারহীনতায় ভুগছে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক কাভারেজ, বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা, রাজনীতিকদের বক্তব্য ও এক্টিভিস্টদের মাথা ব্যাথার শেষ নেই।