স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রায় কর্জে হাসানা দেওয়া কি বর্তমানে সম্ভব?
ঐতিহাসিকভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা অত্যন্ত জনপ্রিয় বিনিময়মাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে কর্জে হাসানা লেনদেনে এর গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা কমে গেছে। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে স্পেকুলেশন বা ফটকাবাজি। বিষয়টি কী?
সাধারণ ব্যাবসাতে একজন ব্যবসায়ী কম দামে পণ্য কিনে সেটি লাভে বিক্রি করে। স্পেকুলেশন আর ফটকাবাজিতেও একই কাজ হয়; অর্থাৎ কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রির চেষ্টা। তাহলে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য হচ্ছে সাধারণ ব্যাবসাতে আপনি জানেন, কত টাকা লাভ হতে পারে। আপনি আপনার পুঁজি অনুযায়ী কম দামে কোনো সোর্স থেকে পণ্যটা কেনেন এবং বাজারের জানা দামে আপনি সেটা বিক্রি করে লাভ তোলেন। আপনার এটি বিক্রি করতে কত সময় লাগতে পারে সে আইডিয়া আপনার আছে এবং সেভাবেই আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত যে, কত দিনে কত টাকা আয় হবে। আপনার ধারণার চেয়ে বেশি বা কম বিক্রি হলেও তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয় না।
কিন্তু ‘ফটকাবাজি কোনো নিয়মিত ব্যাবসা নয়। এটা শুধু ‘ধারণা’র ওপর ভিত্তি করে চলে। মনে করুন, ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ বাধলে সেই দেশে খাবারের দাম বাড়ে। কারণ, উৎপাদন কমে যায় যুদ্ধের কারণে। এবার মার্কেটের ‘ফটকাবাজরা ইউক্রেনের কিছু খাবারের কোম্পানির শেয়ার কিনবে তাতে এই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কিছুটা ওপরের দিকে উঠবে। এবার এই তথ্য চারিদিকে তারা ছড়িয়ে দেয় যে, ইউক্রেনের খাবার কোম্পানিগুলো অনেক লাভ করতে যাচ্ছে। সুতরাং এর শেয়ারের দাম বাড়বে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দেখে যে, তাই তো দাম বাড়ছে; তারাও লাভের আশায় এই শেয়ার কিনতে থাকে। আর সেই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম হুহু করে বেড়ে যায়। এবার এই ‘ফটকাবাজরা, তাদের আগে কম দামে কেনা শেয়ার চড়া দামে বিক্রি করে। আর এই বিক্রির কারণে দেখা যায়, শেয়ারের দাম কিছুটা কমে। এই কমা দেখে বাদবাকিরা ভাবে, হায় হায়! আমাদের তো লস হতে পারে, এবার সবাই তাদের শেয়ার বিক্রি করা শুরু করে আর সেই কোম্পানিগুলোর দাম একদম তলানিতে চলে আসে। খেয়াল করুন, এই কাজে সেই কোম্পানির কত টাকার বিক্রি হলো, কত টাকা লাভ হলো, আসলেই কোম্পানি লাভ করবে কি না এমন কোনো কিছুর চিন্তা কারও মাথায় নেই। তাই মানুষের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা সাময়িক বেচাকেনার হিড়িক হলো ফটকাবাজি। এটি হতে পারে সোনা দিয়ে অথবা বিদেশি মুদ্রা দিয়ে কিংবা
খনিজ সম্পদ নিয়ে (জ্বালানি তেল, গ্যাস, লোহা ইত্যাদি)। এমনকী ঘরবাড়ি, খাদ্যশস্য ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু দিয়েও স্পেকুলেশন করার ঘটনা নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার। ফটকাবাজরা নিয়মিত ব্যাবসা হিসেবে এই পণ্যগুলো কিনতে আগ্রহী ব্যাপারটা সে রকম নয়। তারা কেনে কেবল অধিক লাভে বিক্রি করার আশায়। তাদের প্রত্যেকেই আশা করে দাম আরও বাড়বে এবং পরবর্তী সময়ে তারা এই পণ্য অধিক লাভে বিক্রয় করতে পারবে। কিন্তু এই খেলায় কেউ জিতলে কেউ হারবে সমীকরণটি এমনই।
সব ফটকাবাজরা যখন একটি পণ্যের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তখন দাম বাড়তে বাড়তে আকাশের দিকে রওয়ানা দেয়। আবার সবাই যখন হাতের পণ্য বিক্রি করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, পণ্যের দাম ফাটা বেলুনের মতো এক মুহূর্তে চুপসে যায়। ফাইন্যান্সের ভাষায় একে বলে বাবল বার্স্ট (Bubble Burst)। স্পেকুলেশনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শেয়ারবাজার, জমি ও সোনার ক্ষেত্রে। তবে যেকোনো ইনভেস্টমেন্ট প্রোডাক্ট দিয়েই ফটকাবাজি করা সম্ভব।
এই ‘ফটকাবাজির কারণে অনেক সময় সোনার মূল্য একবার তুঙ্গে ওঠে আরেকবার ধুলায় নামে। এমন ঘনঘন দাম পরিবর্তন মুদ্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি Store of Value বা সঞ্চয়ের সক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক। মনে করি, কর্জে হাসানা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শান্ত এই বছর পাঁচ ভরি সোনা কর্জ নিল। কর্জের সোনা হাতে পাওয়ার পরে শান্ত তা ভরি-প্রতি ৭৫ হাজার টাকা করে মোট ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিলো। পরের বছর বহু কষ্টে সে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা সঞ্চয় করল। তার স্বপ্ন ছিল এই টাকা দিয়ে সব কর্জ পরিশোধ করে দেবে। পরিকল্পনা মোতাবেক সে সমস্ত সঞ্চয় নিয়ে সোনার দোকানে আসার পর আবিষ্কার করল, এক ভরি সোনার দাম ৭৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়ে গেছে ৮৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ কর্জ পরিশোধ করতে হলে কিনতে হবে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকার সোনা। এমন পরিস্থিতিতে শান্তর মনে হবে, কর্জে হাসানা না নিয়ে ব্যাংকের থেকে ঋণ নিলেই ভালো হতো। আবার এমন যদি হতো যে, বছর ঘুরে সোনার দাম কমে গেছে ভরিতে ৭০ হাজার টাকা, তাহলে শান্ত খুব খুশি হতো। কিন্তু ঋণদাতার মুখ কালো হয়ে যেত। এই ধরনের ঝুঁকি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সমস্যাজনক। যেসব অর্থনীতি অস্থিরতায় নেই, সেখানে সোনার তুলনায় আজকাল কাগুজে মুদ্রা একটু বেশিই স্থিতিশীল বা কম উঠানামা করায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাগুজে মুদ্রায় লেনদেন একটু বেশি পছন্দ করে।
Pingback: পণ্য বর্জন করা কি কোন সমাধান? - মোহাইমিন পাটোয়ারী