আপনারা সবাই জানতে চেয়েছেন শেয়ারের দাম কেন উঠানামা করে? এই একটি প্রশ্নের উত্তরে এই পর্যন্ত একটি নয়, দুইটি নয়, শত শত বই এবং হাজার হাজার গবেষণা পত্র প্রকাশ পেয়েছে। আজকে সেই হাজারো গবেষণার নির্যাস থেকে গল্পে গল্পে অর্থনীতির আরেকটি অধ্যায় নিয়ে হাজির হওয়া যাক।
অনেক দিন আগে আমাদের গ্রামে শরত বাবু নামে একজন নামকরা কুমোর ছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল তিনি মাটির হাঁড়ি ও থালা বাসন তৈরির বড় একটি কারখানা প্রতিষ্ঠার করবেন। কিন্তু এত বড় উদ্যোগ নেবার মত টাকা তাঁর ছিল না। তাই তিনি ৫০ জন গ্রামবাসীর থেকে ১,০০০ টাকা করে মোট ৫০,০০০ টাকা চাঁদা তুললেন এবং নিজের পক্ষ থেকে ৫০,০০০ টাকা দিয়ে মোট এক লক্ষ টাকা বিনিয়োগে গ্রামের পাশেই বড় একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করলেন।
চুক্তি মোতাবেক প্রতিবছর লাভের ৫০ শতাংশ শরত বাবু রাখবেন, যেহেতু তাঁর শেয়ারের সংখ্যা ৫০ টি। বাকি সকল বিনিয়োগকারী লাভের ১ শতাংশ করে পাবেন যেহেতু তাদের শেয়ার একটি। বিনিয়োগকারীরা ধারণা করেছিলেন প্রথম বছরে কারখানার লাভ হবে ১০,০০০ টাকা ( বা শেয়ার প্রতি ১০০ টাকা), কিন্তু প্রথম বছরেই কারখানার লাভ হল ১২,০০০ টাকা। শুনে সবার চোখ কপালে। সাথে সাথে শেয়ারের দাম বেড়ে হয়ে গেল। সবাই বুঝে গেছে এই কারখানা সোনার হরিণ। এদিকে গ্রামের মাতবর কেহেরমান সাহেবের দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে এই কারখানা আরও লাভজনক হবে। তাই তিনি এই ১০ টি শেয়ার অর্ডার দিলেন। এক গুলো শেয়ার একসাথে অর্ডার পড়ায় দাম আরও বেড়ে হয়ে গেল।
কিন্তু পরের বছরে বিধি বাম। এলাকার জমিদার নতুন করে ২০ শতাংশ খাজনা বসালেন কারখানার লাভের উপর। সেই বছর মোট লাভ হয়েছিল ১,৩০০ টাকা কিন্তু বিনিয়গকারীরা পেলেন মাত্র ১,০৪০ টাকা। তাই শেয়ারের দাম আবার পড়ে গেল।
এই তো গেল লাভ ক্ষতির হিসেব। এর বাহিরের কিছু হিসেবও শেয়ারের দামকে প্রভাবিত করে। যেমন কিছু দিন পরে গুজব উঠল শরত বাবুর স্বাস্থের অবস্থা ভালো না, আর বেশি দিন বাঁচবে না। এই কথা শুনে বিনিয়োগকারীদের কপালে ভাঁজ। শরত বাবুই যদি না থাকেন এত সুন্দর করে কারখানা চালাবে কে? তাই তাড়াতাড়ি শেয়ার বিক্রি করার চিন্তা ঘুরতে শুরু করল সকল বিনিয়োগকারীর মাথায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখন কেনার মত কোন প্রার্থী নেই। তাই দাম কমতে কমতে মাত্র ৬০০ তে নেমে গেল। তারও পরের মাসেই পাশের গ্রামে কলেরা মহামারি শুরু হয়ে গেল। বিপদ আসন্ন দেখে সবাই হাতের কাছে টাকা রেখে দেবার পরিকল্পনা শুরু করলেন। ফলে শেয়ার বিক্রির ধুম লাগলো কিন্তু কেনার মোট কেউ নেই। কিছু দিনের মাঝে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল, শরত বাবু সুস্থ হয়ে গেলেন। তিনি ঋণ নিয়ে ব্যবসা আরও বড় করলেন, নতুন কর্মী নিয়োগ দিলেন, সুন্দর সুন্দর কিছু যন্ত্র পাতি আমদানী করলেন। শেয়ারের দাম বেড়ে তুঙ্গে।
এভাবে কিছু বছর যাবার পরে ইংরেজরা নতুন নতুন স্টিলের হাঁড়ি, কাচের থালা বাটি ইত্যাদি আমদানি করা শুরু করলেন। নতুন পণ্য দেখে সবাই সেগুলো কেনা শুরু করল। দেশে মাটির জিনিস পত্রের বিক্রি একেবারেই কমে গেল। বিনিয়োগকারীদের মাথায় হাত। কিন্তু ব্যবসায় ঋণের বোঝা কোন অংশে কমল না বরং সুদে আসলে লাগামহীন বেড়ে গেল। এক পর্যায়ে ঋণের পরিমাণ ব্যবসার মোট সম্পদের থেকে বৃদ্ধি পেয়ে গেল বা ব্যবসা দেউলিয়া হয়ে গেল। তাই সকল শেয়ারের মূল্য হয়ে গেল শূন্য টাকা। এভাবে শরত বাবু এবং বাকি সকল বিনিয়োগকারী সব হারালেন।