লকডাউন অর্থনীতি

লকডাউনের ফলে যে জনগনের আয় রোজকারের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয় তা আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু এই ক্ষতিটা হয় কি করে? বাংলাদেশে  যদি সব মিলিয়ে ১০০০ কোটি টাকার কাগুজে মুদ্রা বা নোট থাকে লকডাউনের ফলে তার সংখ্যা কমার বা বাড়ার কথা নয় কারণ আমরা লকডাউনে টাকা পুড়িয়ে ফেলছি না বা কেউ ছোবল দিয়ে তা মহাশূন্যে নিয়ে যাচ্ছে না। তাই একজনের হাতে টাকা কমে গেলে অপর জনের হাতে বেড়ে যাবার কথা। কিন্তু লকডাউনে গুটিকতক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাতিত প্রায় সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং সেই গুটিকতক প্রতিষ্ঠানের লাভের অংক সমগ্র দেশের ক্ষয় ক্ষতির সমান নয়। টাকাতো কেবল মাত্র হাত বদল করে। সেই প্রেক্ষিতে সকলের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কি করে সম্ভব বা সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হলে টাকাটা (বা ডলার বা ইওরো) গেল কোথায়?

আসলে আমরা টাকাকে যেভাবে দেখি বা জানি বাস্তব তার থেকে অনেকটা ভিন্ন। বর্তমানে একটি অর্থনীতির মোট টাকার সিংহভাগই (প্রায় নব্বই শতাংশ) উৎপাদন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ।

একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। ধরা যাক খুব ছোট্ট একটি দ্বীপে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ বসবাস করে এবং তারা স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে সকল লেনদেন সম্পন্ন করে। সব মিলিয়ে দ্বীপটিতে ১০০০ মুদ্রা আছে। এখন সেই দ্বীপে গিয়ে আমি একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করি এবং সকলের জন্যে একটি করে ব্যাংক একাউন্ট খুলে দেই। ব্যাংকে সোনা রাখা নিরাপদ ভেবে অধিকাংশ মানুষ ব্যাংকের সিন্দুকে মুদ্রা জমা রাখতে থাকে এবং আমার সিন্দুকে ৮০০ মুদ্রা জমা পড়ে।

এখন দ্বীপের এক জনের সাথে অপরজনের লেনদেন হলে তারা সোনা তুলে নিয়ে লেনদেন করে অথবা চেক লিখে দেয়। সোনা তুলে লেনদেন করলে দিন শেষে ঘুরে ফিরে তা আমার হাতেই আসে কারণ অধিকাংশ মানুষই ব্যাংকে মুদ্রা জমা রাখে। অপরপক্ষে চেক লিখে দিলে আমি শুধু একাউন্টের নাম পরিবর্তন করে দেই, মুদ্রা সিন্দুকেই থাকে। এইভাবে বিপুল পরিমাণ অলস মুদ্রা সিন্দুকে পড়ে থাকে। তাছাড়া সকল সদস্য একসাথে সোনা তুলতে আসে না, কেউ জমা রাখে আবার কেউ তোলে। তাই আমি ১০০ মুদ্রা সিন্দুকে জমা রেখে বাকি ৭০০ মুদ্রা ঋণ দিয়ে দেই। এই রুপে ব্যাংকের সঞ্চিত মুদ্রা পুনরায় বাজারে প্রবেশ করে। দ্বীপে গিয়ে গণনা করলে ৯০০ মুদ্রা পাওয়া যাবে, বাকি ১০০ আমার সিন্দুকে। কিন্তু গ্রাহকদের হিসেব মত আরও ৭০০ মুদ্রা ব্যাংকে আছে। অর্থাৎ, সেই দ্বীপের মোট মুদ্রার পরিমাণ সকলের গণনা মতে ১৭০০ (ব্যাংক ডেপসিট ৮০০, বাজারে ২০০+৭০০)।

এখন দ্বীপের ৯০০ মুদ্রা থেকে যদি আবার ৭০০ মুদ্রা আমার হাতে আসে আমি পুনরায় ১০০ মুদ্রা রেখে ৬০০ মুদ্রা ঋণ দিয়ে দিব। তাহলে আমার সিন্দুকে মোট মুদ্রার পরিমাণ থাকবে ২০০ এবং মানুষের হাতে ৮০০। কিন্তু ব্যাংকে জমা সহ মুদ্রার পরিমাণ এখন ২৩০০। এই ধারা চলতে থাকলে এক পর্যায়ে দ্বীপের মোট মুদ্রার চেয়ে আমার ব্যাংক আকাউন্টে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি হয়ে যাবে।

যতদিন পর্যন্ত ব্যাংক ব্যাবস্থার উপরে মানুষের বিশ্বাস থাকবে এবং ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন চলতে থাকবে ব্যাংক ব্যালান্স মুদ্রার বিকল্প হিসেবে ব্যাবহৃত হতে থাকবে অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে এম ১। মানুষ যত ঋণ নিবে মুদ্রার পরিমাণ তত বাড়বে আর যত জন দেউলিয়া হবে মুদ্রার পরিমাণ তত কমবে।

গল্পটি হিরক রাজার দেশের মত হলেও বাস্তব এমনই। ঋণ হচ্ছে টাকা। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যাংকের থেকে কেউ ঋণ বা ক্রেডিট নেয় না, ফলে টাকা উৎপাদন কমে যায়। আবার কেউ দেউলিয়া হয়ে গেলেও টাকার পরিমাণ কমে যায়। তবে এই টাকা অদৃশ্য বলে তা দেখতে পাইনা। এইভাবে সকলের অবস্থা একই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং টাকার পরিমাণ কমে যায়। টাকার পরিমাণ কমায় সাময়িক মুল্যহ্রাস বা ডিফ্লেশন দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন টাকা ছাপিয়ে এবং ঋণ সহজীকরণ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। এভাবে মূল্য স্বাভাবিক থাকে এবং অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরায় চাঙ্গা হলে দেশে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়।

শেয়ার করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *