বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ বা ফোরেক্স রিজার্ভ কি?

পত্রিকা খুললেই আমরা দেখতে পাই আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ এত বেড়েছে বা এতো কমেছে। কিন্তু এই রিজার্ভটা আসলে কী? চলুন আজকে গল্পটাই করি সহজ – সরল বাংলায়।

মনে করি, সাবানা এবং পুর্ণিমা দুই জনই বাংলাদেশে থাকে। তারা যখন নিজেদের মধ্যে কেনাকাটা করবে যেমন সাবানা তার বোনের জন্য পুর্ণিমার দোকান থেকে একটি পাঞ্জাবি কিনবে তখন তারা কোন মুদ্রা ব্যবহার করবে? নিশ্চয়ই টাকা। কারণ বাংলাদেশের সকল প্রান্তে টাকা একটি গ্রহণযোগ্য বিনিময় মাধ্যম।

কিন্তু আমরা যখন ভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য করি বা ভ্রমনে যাই, তখন দেশীয় মুদ্রা ব্যাবহার করতে পারি না। যেমন, রাজিব সাহেব ব্রিটেন থেকে একটি রোলস রয়েলস গাড়ি কিনতে চাইছেন, সেক্ষেত্রে রোলস রয়েলস কোম্পানিকে যদি রাজিব সাহেব বাংলাদেশী টাকার একটি ব্রিফ কেস ধরিয়ে দেন তাহলে কি হবে? এক কথায় রোলস রয়েলস মহা ফ্যাসাদে পড়বে। এই টাকা দিয়ে কোম্পানি তাদের শ্রমিকদের বেতন বা ট্যাক্স কিছুই দিতে পারবে না। কারণ ব্রিটেনে বাংলাদেশী টাকা চলে না, সেখানে চলে পাউন্ড। তাই গাড়ি কিনতে রাজিব সাহেবের প্রয়োজন হবে পাউন্ড। 

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে পাউন্ড তৈরি হয় না। বাংলাদেশ তো দূরের কথা, খোদ ব্রিটেন বাদে আর কোন দেশ পাউন্ড তৈরি করতে পারে না। রাজিব সাহেব যদি টাকার বিপরীতে পাউন্ড কিনতে যান হয়তো তিনি কোন গ্রাহক পাব না। কারণ একজন ব্রিটিশ ব্যাক্তি যখন পাউন্ড বিক্রি করে টাকা কিনবেন তিনি এই টাকা কোন কাজে লাগাতে পারবেন না। যদি না তিনি বাংলাদেশ থেকে কিছু ক্রয় করেন অথবা বাংলাদেশে ভ্রমণ করেন। 

অপরপক্ষে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যখন আমরা ইউরোপে রপ্তানি করি তখন আমরা অর্জন করি ইউরো। কিন্তু ইউরো দিয়ে দেশের বাজারে কেনাকাটা করা বা শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব না। আবার একজন ইউরোপীয় ক্রেতার পক্ষেও বাংলাদেশী টাকা অর্জন করা সবসময় সম্ভব না। এর ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেনে মুদ্রার ভিন্নতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

এই সমস্যা দূর করতে আগেকার দিনে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যাবহার করা হত সোনা (অথবা রুপা)। যেহেতু বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ভিন্ন ভিন্ন, সেহেতু সোনা ছিল আন্তর্জাতিক লেনদেনের সাধারণ মুদ্রা। কোন দেশ পণ্য রপ্তানি করলে সেই দেশের কোষাগারে স্বর্ণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। আবার আমদানি করার সময় কোষাগারে থেকে স্বর্ণের পরিমাণ হ্রাস পেত। অর্থাৎ, স্বর্ণই ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা। এভাবেই চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত।

কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় দেশ গুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণী হয়ে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ হারিয়ে ফেলে। ফলে তাদের দ্বারা আর টাকার বিপরীতে সোনা মজুদ করে রাখা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে নতুন নিয়ম জারি করা হল। একমাত্র মার্কিন ডলারের বিপরীতে সোনা মজুদ থাকবে আর বাদবাকি সকল মুদ্রা ডলারের সাথে সামাঞ্জস্য বজায় রাখবে। এভাবে মার্কিন ডলার হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাধারণ মুদ্রা। 

তখন থেকেই দুইটি ভিন্ন দেশ তাদের নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য করত ডলারে। কারণ তাদের হাতে প্রয়োজনীয় স্বর্ণ ছিল না এবং ডলারের বিপরীতেই কেবল স্বর্ণ মজুদ ছিল। এক কথায় ব্রেটন উডস চুক্তির পরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার হয়ে উঠল নতুন স্বর্ণ।

পরবর্তীতে আমেরিকা তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি, তারা চুক্তির উল্লিখিত পরিমাণের অতিরিক্ত ডলার ছাপাতে থাকে। এই ব্যাপারে অভিযোগ উঠলে ১৯৭১ সালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলারের বিপরীতে সোনার মজুদ ব্যাবস্থা বাতিল ঘোষণা করে। এইভাবে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড এর ইতি ঘটে। বর্তমানে কোন মুদ্রার বিপরীতেই সোনা মজুদ নেই।

কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাবে বনিজ্যের জন্যে একটি সাধারণ মুদ্রা প্রয়োজন, যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। বর্তমানে সেই গ্রহণযোগ্য সাধারণ মুদ্রার রাজ-আসন ব্রেটন উডস এর কল্যাণে দখল করে আছে মার্কিন ডলার। তাই কোন দেশ যখন রপ্তানি করে বা রেমিট্যান্স আয় করে তখন আয় হয় ডলারে। আবার কোন দেশ যখন আমদানি করে তখন ব্যয় হয় ডলারে। আর এই দুয়ের পার্থক্য কোষাগার থেকে যোগ বিয়োগ করে নিতে হয়।

একটি পরিবারের আয় অপেক্ষা ব্যয় কম হলে যেমন সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়, ঠিক তেমনি একটি রাষ্ট্রের ডলার আয় অপেক্ষা ব্যয় কম হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়। আর এই সঞ্চয়কেই ইংরেজিতে বলে রিজার্ভ। অনেক সময় একে ফরেক্স রিজার্ভও বলা হয়ে থাকে। ফরেক্স শব্দের অর্থ হচ্ছে ফরেইন এক্সচেঞ্জ বা বৈদেশিক লেনদেন। যেহেতু আমরা বৈদেশিক লেনদেনের মাধ্যমে এই সঞ্চয় বা রিজার্ভ অর্জন করেছি তাই একে বলি ফরেক্স রিজার্ভ।

রিজার্ভ যে সবসময় ডলারেই থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। স্বর্ণের কোষাগার থেকে যেমন স্বর্ণ বিক্রয় করে অন্যান্য সম্পদে রুপান্তর করা সম্ভব, ঠিক তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই ডলার বিক্রয় করে ইউরো, ইয়েন বা স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি কিনে রাখতে পারে। 

অনেক সময়ই ব্যাংক এই বিশাল অংকের রিজার্ভ কেবল ডলারে সঞ্চিত না রেখে সম্পদের ঝুলিতে বৈচিত্র বা ডাইভার্সিটি আনতে বিভিন্ন সম্পদ, যেমন ইউরো, ইয়েন, স্বর্ণ ইত্যাদিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। এই সকল সম্পদের সম্মিলিত বাজার দরের পরিমাণই হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ।

মোহাইমিন পাটোয়ারী

শেয়ার করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *