আমি এই পর্যন্ত মোট চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছি। এর মধ্যে সেরা প্রতিষ্ঠান ছিল নরওয়েজিয়ান স্কুল অব ইকনোমিক্স (সংক্ষেপে NHH)।
প্রতিষ্ঠানটিকে ভালো লাগার প্রথম কারণ ছিল সেখানের কারিকুলাম। নরওয়েতে মুখস্তবিদ্যার কোন স্থান ছিল না। পোড়াশোনা ছিল মেধা ও জ্ঞান ভিত্তিক। বিভিন্ন ফাইন্যান্সিয়াল থিওরি গভীরে না বুঝলে আপনি পরীক্ষায় এ গ্রেড পেতে পারবেন না। আবার আপনি যদি সবকিছু পরিষ্কার বুঝে থাকেন এবং চর্চা করেন, তাহলে কোন কিছু মুখস্ত না করেই ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারবেন। সম্পূর্ণ সেমিস্টারের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কি কি পড়ানো হয়েছে, পুরোটা একসাথে মাথায় থাকতে হতো। বুঝাতে গ্যাপ থাকলেই পরীক্ষার হলে ধরা খাবেন।
দ্বিতীয় যেই বিষয়টি ভালো লাগতো তা হচ্ছে বাস্তবমুখী পাঠ। শ্রেণীকক্ষের পাঠগুলো কীভাবে বাস্তব বিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে তা আমরা নিজ চোখে দেখতে পেতাম। কখনো পড়তে গিয়ে মনে হয় নাই, “আমি এগুলো কেন পড়ছি?” “এগুলো জীবনে কী কাজে লাগবে?” “কবে এই বিরক্তিকর পড়া শেষ হবে?” ইত্যাদি।
আর শিক্ষকরাও ছিলেন অসম্ভব জ্ঞানী। তাদের কথাবার্তা, জ্ঞান-বুদ্ধি, বন্ধুসুলভতা সবই ছিল দেখার মত। এমনকি বোকার মত প্রশ্ন করলেও শিক্ষকরা বিরক্ত হতেন না। তাদের মাঝে সততা ছিল। তাই পরীক্ষার পরে যেই গ্রেড পেতাম তাতে কখনো মনে হতো না যে শিক্ষক আমার প্রতি অবিচার করেছেন। যদি কোন শিক্ষকের ক্লাস আপনার পছন্দ না হতো আপনি চাইলে তার কোর্স না করতেই পারতেন। প্রতি সেমিস্টারের প্রথম এক মাস বিভিন্ন ক্লাসে ঘুরে ঘুরে নিজের পছন্দমত কোর্স বাছাই করার সুযোগ ছিল। আর আমার মত উৎসাহী ব্যক্তি সেই সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করতো। মাঝে মাঝে কিছু ক্লাসে গিয়ে কেবল জ্ঞান নেওয়ার জন্যও বসে থাকতাম।
সবশেষে, সহপাঠীরা ছিল খুব যোগ্য এবং কর্মঠ। তাদের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে যেমন কষ্ট হয়েছে, তেমন শেখাও হয়েছে। মাঝে মাঝে পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলে সবুজ মাঠে হাঁটতাম আর স্বচ্ছ জলরাশির দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, “আমাদের দেশের সেরা ছাত্রদের সাথে পড়াশোনা করেছি, এই দেশেরও সেরা ছাত্রদের সাথে পড়াশোনা করছি। কিন্তু তাদের মধ্যে মেধার দৌড়ে এতো তফাত কেন?” বিজ্ঞানীরা বলেন প্রতি একশ জনে ১ জন জিনিয়াস হয়ে জন্মায়, সেই হিসেবে ১৭ কোটী মানুষের সেরারা ৫০ লক্ষের সেরাদের চেয়ে অনেক মেধাবী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে কেন তার বিপরীত চিত্র দেখা যায়? এখন ভাবি আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাই সেরাদেরকে উপরের দিকে তুলতে পারে না। গোড়াতে উপড়ে ফেলে। সেজন্য কেউ মেধাবী হয়ে জান্মালেও কেবল হতাশায় ভোগে এবং এক পর্যায়ে লেখাপড়ার প্রতি বিতৃষ্ণ হাল ছেড়ে দেয়।