সমবায় পদ্ধতিতে হাওলাত বা কর্জে হাসানা প্রতিষ্ঠান

কেউ যদি টাকা ব্যবহার করে কর্জে হাসানা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে চায়, তার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় সমাধান হচ্ছে সমবায় পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কোন জটিল হিসেব নিকেশ, প্রতিষ্ঠা ব্যয় কিংবা পরিচালনা ব্যয় নেই। সমবায়ে সবাই ভাগাভাগি করে দ্বায়িত্ব পালন করে তাই এতে কোন কর্মচারী বেতন নেই। একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিলেই হয়। প্রতিমাসের সবাই চাঁদা দিবে এবং কারো প্রয়োজনে কিছু টাকা নিতে পারবে। আবার দিন শেষে ফিরিয়ে নিবে। কেউ তার সমস্ত জমা ফেরত নিতে চাইলে খরচ এবং ঋণ বিফল বাদে বাকি সকল টাকা ফেরত পাবে।  

সমবায় পদ্ধতিতে সকলে একত্রে টাকা জমা করবেন  এবং কেউ বিপদে পড়লে এখান থেকে যে কেউ বিনা সুদে ঋণ নিতে পারবেন। 

সমবায় পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারী সকল সদস্য প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিবেন এবং সেই মাসে যাদের যাদের টাকা প্রয়োজন তারা অবেদনপত্র জমা দিবেন। আবেদনকারীদের প্রয়োজন বুঝে ঋণ অনুমোদন হবে এবং তাদেরকে সেই মাসের সকলের চাঁদা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। প্রতিটি মানুষের জীবনেই কোন না কোন একটি পর্যায়ে টাকার প্রয়োজন হয়। সেই হিসেবে এই পদ্ধতিতে সকলেই লাভবান হচ্ছেন।

এই পদ্ধতির আরেকটি মজদার ব্যপার হচ্ছে, সময়ের সাথে মোট টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধরা যাক একটি পাড়ার ২৪ জন ব্যক্তি মিলে এই উদ্যোগ নিলেন, প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে সদস্যরা চাঁদা দিবেন। এভাবে প্রথম মাসে মোট ঋণ ইস্যু করা সম্ভব ১২ হাজার টাকার। মনে করি, প্রথম মাসে শুখু তার পুত্রের বিয়ের জন্য ১২ হাজার টাকা ঋণ নিল এবং প্রতিমাসে ১ হাজার টাকা করে শুখু মোট এক বছরে সকল ঋণ পরিশোধ করে দেওয়ার চুক্তি করল। পরের মাসে টুনি ও শাকিল ১ বছরের কিস্তিতে ঋণ চাইল। যেহেতু এই মাসে শুখু ১ হাজার টাকা ফেরত দিবে, মোট ঋণ ইস্যু করা সম্ভব হবে ১২ হাজার + ১ হাজার অর্থাৎ, ১৩ হাজার টাকার। এভাবে প্রথম ঋণ ইস্যু করার এক বছর পরে প্রতি মাসে মোট ঋণ দেওয়া সম্ভব হবে ২৪ হাজার টাকার, দ্বিতীয় বছর শেষে ৩৬,০০০ এরূপ। এভাবে বৃদ্ধি পাবার কারণ হচ্ছে সদস্যদের জমাকৃত টাকা। প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে বছরে একজন সদস্য প্রতি বছর জমা করছেন ৬ হাজার টাকা এবং তিন বছরে জমা করছেন ১৮ হাজার টাকা। যেহেতু সময়ের সাথে মোট জমার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিক তেমনি ঋণ প্রদানের সক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে জমা শব্দ ব্যবহার না করে আমাদের কর্জে হাসানা শব্দ ব্যবহার করা উচিত। কারণ টাকা জমা করে কোন কল্যাণ হয় না, বরং কর্জে হাসানাতে হয়। সমবায় পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তি কেবল কর্জে হাসানা দিচ্ছেন তা নয়, নিজের প্রয়োজনে নিতেও পারছেন। আরেকটা ভালো ব্যপার হচ্ছে একটি সমবায়ের সকল সদস্য একজন আরেকজনকে চিনেন, তাই ঋণ গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রয়োজন যাচাই খুব সহজ, এর জন্য বিস্তর অনুসন্ধান পূর্বক রিপোর্ট প্রদানের প্রয়োজন নেই। 

এবার আসা যাক কোন সদস্য এই ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে যেতে চাইলে কি হবে সেই আলোচনা করা যাক। মনে করি রতন বিদেশে কাজ করতে বা পড়াশুনা করতে চলে যাচ্ছে। অথবা কণার বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে তারা সদস্য পদ পরিত্যাগ করতে চায়। কোন সদস্য যেতে চাইলে তার টাকা পাওয়ার অধিকার সবার চেয়ে প্রয়োজনীয় বলে বিবেচ্য হবে। অর্থাৎ, কণার যদি পৌষ মাসে বিবাহ হয় এবং সেই মাসেই সে সদস্যপদ গুটিয়ে নিতে চায় তাহলে পৌষ মাসের সমস্ত ঋণ আবেদন পত্রের চাইতে কণার টাকা পাওয়ার অধিকার অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। এমন না করতে পারলে পরবর্তীতে সদস্য হিসেবে কেউ যোগ দান করতে চাইবেন না। সুতরাং, টাকা প্রদানকারীর টাকা ফেরত পাবার অধিকারকে ঋণ পাবার অধিকারের চেয়ে প্রাধান্য দিতে হবে। কারো যদি অত্যন্ত প্রয়োজন হয় সে কণার থেকে ব্যক্তিগত ভাবে ঋণ চেয়ে নিবে। কিন্তু সকল সদস্য মিলে কণার টাকার উপরে অধিকার খাটাতে পারবে না। একসাথে দুই তিন জন ব্যক্তি সদস্য পদ বাতিল করতে চাইলে কাকে আগে টাকা ফেরত দেওয়া হবে তা লটারির মাধ্যমে বা সদস্যদের ভোটে নির্ধারন করা যেতে পারে।   

সামান্য কিছু খরচ করে একটি সিন্দুক কিনলে সমবায় পদ্ধতি আরও সুন্দর ভাবে চালানো সম্ভব। দেখা গেল কোন এক বছরের বৈশাখ মাসে সমবায়ের ঋণ দেবার সক্ষমতা ২৪,০০০ টাকার, কিন্তু সেই মাসে ঋণের আবেদন পত্র জমা পড়েছে ৯,০০০ টাকার। আবার জ্যৈষ্ঠ মাসে ঋণ নেবার জন্য মোট আবেদন জমা পড়েছে ৪০,০০০ টাকার কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ঋণ প্রদানে সক্ষমতা ২৫,০০০ টাকার। এমন পরিস্থিতে একটি সিন্দুক থাকলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। লক্ষ্য করুন, বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে মোট ঋণের আবেদন জমা পড়েছে ৪৯,০০০ টাকার এবং প্রতিষ্ঠান মোট ঋণ প্রদান করতে পারবে ৪৯,০০০ টাকা। কেবল মাত্র সময়ের আগ পিছ হওয়াতে এক মাসে অযোগ্য ব্যক্তিকেও ঋণ দিতে হচ্ছে আবার অপর মাসে যোগ্য ব্যক্তি ঋণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 

সিন্দুক থাকার আরেকটা সুবিধা হচ্ছে কেউ চাইলে বাড়তি টাকা জমা রাখতে পারে এই প্রকল্পে। ধরা যাক পাটয়ারী সাহেব ১০০ মন ধান বিক্রি করে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করলেন। তার সংসারের খরচ মাসে ১০ হাজার টাকা। এত টাকা ঘরের আলমারিতে না রেখে তিনি সিন্দুকে জমা রাখলেন এবং এর মাঝে কর্জে হাসানা হিসেবে টাকা ঘুরতে থাকলো। পরবর্তীতে প্রতি মাসে তিনি ১০,০০০ টাকা করে এখান থেকে তুলে সকল ব্যয়ভার বহন করলেন। এভাবে সিন্দুকে টাকা জমা রাখলে অনেক কল্যাণ আছে। সিন্দুকের অভাবে যেকেউ নিরাপত্তা বোধে ব্যাংকের কারেন্ট একাউন্টে টাকা জমা রাখতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা ব্যয় এবং পরিচালনা ব্যয় প্রায় শূন্য টাকা।

শেয়ার করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *