একটি অঞ্চলের সম্পদ হচ্ছে আঞ্চলিক সাহিত্য
আমাদের আঞ্চলিক ভাষা সাহিত্যের অসংখ্য নিদর্শনে ভরপুর। বিয়ের গীত, দরজা খোলার আগের শ্লোক, ধর্মীয় শ্লোক, খেলার ছড়া ইত্যাদির মাঝে মিশে আছে মানুষের জীবন, গ্রামের চিত্র ও সুখ দুঃখের নানা কাহিনী। নতুন প্রজন্মের কাছে এই বিস্তৃত আঞ্চলিক সাহিত্য সম্পদের সামান্য কিছু তুলে ধরার জন্য এই লেখাটা শেয়ার করলাম।
প্রথমে শুরু করি শ্লোক দিয়ে
শ্লোকঃ
নারীদের শ্বশুর বাড়িতে যন্ত্রণার শিকার হওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক না। সাধারনত এইসব পাশ কাটিয়ে চলতে হলেও সকলকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। শ্বাশুড়ির সাথে যেহেতু সবসময় থাকতে হয়, তাই যেই নারীর শ্বাশুড়ি যন্ত্রণা করে তার কপালে বড়ই দূর্ভোগ। কিন্তু তার চেয়েও অধিক দুর্ভোগ সেই নারীর যার স্বামী খারাপ। তাই নারী বলে
“হড়িয়ে জ্বালাইলে শালের হালা (খুঁটি)
আর জামাইয়ে জ্বালাইলে মরণও ভালা।“
(শ্লোকটি আমার খালার থেকে সংগ্রহ করা)
এমন আরও কয়েকটা শ্লোক দেওয়া হলোঃ
“যার আক্কল হয় না নয় বছরে,
তার আক্কল হয় না নব্বই বছরে।“
“হাতি লোদে পড়লে ব্যাং এ ও ঠ্যাং তোলে।”
“হ্যান দি ভাত খাই গপ্পো মারে দই
সালা কাটা বিছাই বলে আমার ছপ্পর খাট কই?”
এবার চলুন শুনি গ্রাম্য জীবনের সাথে মিশে থাকা কিছু শ্লোক।
গ্রামের নিত্যদিনের কাজ কর্ম- যেমনঃ মাছ ধরা, গাছে চড়া, পুকুরে নামা এসব ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শ্লোক। শিল্পী যেমন তুলি দিয়ে ক্যানভাসে ছবি আঁকে ঠিক তেমনি এই শ্লোক গুলোয় আঁকা হয়েছে গ্রামের জীবন।
মাছ ধরার জন্য বড়শী ফেলার সময় মাছকে উদ্যেশ্যে করে ছোটরা বলে,
“মইজ্জার মা কানি
অ্যাঁর বরিগা টানি ,
অ্যাঁর বরিগা সদাগর
ডুবাই ডুবাই তলে ভর।”
( সংগ্রহ করেছি আমার বাবার থেকে)
অর্থাৎ, মানুষ মাছকে বলছে, “বড়শিই সদাগর”, তাই একে টেনে পানির নিচে নামা। মাছকে ঘায়েল করার পূর্বে বড়শির টোপের পাশাপাশি মিথ্যা কথার আরেকটা টোপ ফেলল আরকি।
গাছে উঠতে ছোট বাচ্চারা পিঁপড়ার ভয় পেতো। তাই পিঁপড়ার কামড় থেকে বাঁচতে বলতো
“পিঁপড়া কালা,
গরু মিঠা,
মানুষ তিতা।”( সুত্র : বাবা)
পিঁপড়াকে বলছে মানুষের কাছে না এসে গরুর কাছে যেতে। গরু মিঠা, মানুষ তিতা। এইটা পড়লে আর পিঁপড়া আর কামড়াবে না।
“শীত আমার মিত, আগুন আমার ভাই।
শীতের কাছে বলে দিলাম আমার খাতা কম্বল নাই।“(সুত্র : মা)
ছোট বাচ্চাদের শীতের সময় মুরব্বিরা বলতেন এই শ্লোক পড়ে পানিতে লাফ দিলে আর কোনো শীত লাগবে না।
গানঃ
“হোলার তুনও মাইয়া বড় এই বিয়ার নি ঢক আসে,
এরো হুন্সি মাইয়া নাকি উঠতে হারে তাল গাছে।
আম হাড়ে, সুয়ারি হাড়ে, আরো হাড়ে তাল,
এই বাড়ীর তুন হেই বাড়ী যাইতে টক্কি হার হয় খাল”
গানটি রসিকতায় ভরপুর। তবে এই গানের মধ্যে গ্রামের একটা চিরায়িত চিত্র ভেসে উঠে আমাদের চোখে। লেখক নিখুঁত ভাবে দস্যি মেয়ের বর্ননা দিয়েছেন – পাশের বাড়ী যেতে খাল পার হওয়া, ফল চুরি করা, তাল গাছে উঠার সাহসিকতা গ্রামের শৈশবের সাথে মিশে আছে।
খেলার ছড়াঃ
গোল্লা, কানামাছি, বৌছি, কুতকুত খেলার সময় ছটো ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন ছড়া কেটে কেটে খেলে। এমন কয়েকটি ছড়াঃ
“এরো দিয়া বেরো রে
পলা দিয়ে ধর রে
পলার ভিতর ঝাগুর মাছ
ছটফট করে, ছটফট করে…”
( ছড়াটি আমার ফুফুর থেকে শোনা )
“ঊড়াল দিব আকাশে
জল খাব গেলাশে গেলাশে…”
একটি মজার শ্লোক দিয়ে লেখাটি শেষ করিঃ
আগের দিনে মহিলারা স্বামীর কাছে চিঠি লেখার সময় বিভিন্ন শ্লোক লিখত। মহিলাদের মধ্যে এটা ছিল বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার ব্যাপার। অনেকটা বর্তমানে তরুনীদের মধ্যে মেসেজ পাঠানোর মত। যাই হোক। স্বামী বিদেশে থাকলে চিঠিতে শখ করে মহিলারা এই শ্লোক লিখতঃ
“এক চিঠি দিলাম আমি উপরে আর নিচে,
আর এক চিঠি দিলাম আমি আপনার কাছে।
আসিলে আসিবেন বন্ধু না আসিলে নাই,
পূর্ব পাকিস্তানে আমার স্বামীর অভাব নাই।”
বেচারা স্বামী নিশ্চয়ই চিঠি পেয়ে খালি পায়েই বাড়ির দিকে দৌড় দিবে।
আসসালামুআলাইকুম,
ভাইয়া কি নোয়াখালীর নাকি ?