ফটকাবাজি কী?

ফটকাবাজি কি?

ফটকাবাজি শব্দটি শুনতে খারাপ লাগলেও এর চর্চা সর্বব্যাপী। তার চেয়েও মজাদার তথ্য হচ্ছে এটি আইগত ভাবে বৈধ। অর্থসাস্রের সংজ্ঞানুযায়ী দ্রুত ক্রয় বিক্রয়যোগ্য উপকরণ যেমন- শেয়ার, বন্ড বা মুদ্রার বাজারমূল্য ওঠানামার সুযোগেকে কাজে লাগিয়ে অধিক লাভ করার ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগকে নেওয়াকে বলে ফটকাবাজি (বা speculation)। সহজ ভাষায় কোন বস্তুর অন্তর্নিহিত গুণাবলী যেমন একটি কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ, বার্ষিক আয় এবং ঋণের পরিমাণ ইত্যাদি বিবেচনা না করে কেবল মাত্র দামের গতি প্রকৃতি অনুমান করে শেয়ারে লাভ করার প্রচেষ্টাকে বলে ফটকাবাজি।

আপনারা অনেকেই হয়তো বুঝে বা না বুঝে ফটকাবাজি করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আপনি একা নন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, সবাই কোন না কোন ভাবে ফটকাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে। ব্যাংক এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর হাতে অনেক সময় প্রচুর পরিমাণ টাকা অলস পড়ে থাকে। তারা এই টাকাগুলো অলস ফেলে না রেখে স্বল্পমেয়াদে অধিক লাভ করার সুযোগ খোঁজে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুদ্রার দাম, কিংবা খনিজ সম্পদ যেমন জ্বালানী তেল, গ্যাস এবং স্বর্ণ ইত্যাদির বাজারমূল্যের উঠানামাকে কেন্দ্র করে রাতদিন বাজিতে বিনিয়োগ করতে থাকে। সবার লক্ষ্য থাকে প্রতিটি বাজিতেই লাভ করতে। কিন্তু স্পেকুলেশন একটি জিরো সাম গেম, অর্থাৎ, কেউ হারলে কেউ জিতবে এমন। শুধু বড় প্রতিষ্ঠান নয়, ছোট এবং মাঝারি বিনিয়োগের অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রাত দিন বিশ্বের আনাচে কানাচে  স্পেকুলেটিভ লেনদেন করতে থাকে। ব্যাংক অফ ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টের ২০১৯ সালের গবেষণা পত্রে প্রকাশ করা হয়েছে যে মুদ্রা বাজার বা ফরেক্স মার্কেটের দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ হচ্ছে ৬.৬ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ একই সময়ে পৃথিবীর জিডিপি বা মোট উৎপাদন ছিল ৮৪ ট্রিলিয়ন ডলার (সূত্র – বিশ্ব ব্যাংক)। অর্থাৎ, পৃথিবীর প্রতিটি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান এক বছরে যে পরিমাণ আয় করে কেবল মাত্র ফোরেক্স মার্কেটেই দুই সপ্তাহে তার সমান মুদ্রা লেনদেন হয়ে যায়। এই লেনদেন যে বস্তুগত পণ্য এবং সেবার বিনিময়ে করা হচ্ছে না তা মোটেও না। তথ্য সূত্র দেখলে আমরা এর প্রমাণ পাই। পৃথিবীর মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ হচ্ছে বছরে ১৯ ট্রিলিয়ন ডলার যা ফোরেক্স মার্কেটের মাত্র তিন দিনের আয়ের সমান। অর্থাৎ মুদ্রা বাজারের লেনদেনের সিংহ ভাগই ফটকাবাজি। 

কেবল মাত্র মুদ্রা বা শেয়ার বাজারেই ফটকাবাজি হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে এমনকি ঘর বাড়ি, খাদ্যশস্য সহ সকল নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিতে 

ফটকাবাজি বা স্পেকুলেশন একটি নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা।

স্পেকুলেটররা প্রতিনিয়ত পণ্যমূল্যের গতি প্রতির উপরে চোখ রাখে এবং সকল মূল্য পরিবর্তন থেকে লাভ হাসিল করার চেষ্টা করে। তাই যেকোন পণ্যের দাম বৃদ্ধি (বা হ্রাস) পাওয়ার সাথে সাথেই তারা আগ্রহী হয়ে উঠে। ধরা যাক, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। স্পেকুলেটররা যদি মনে করে ভবিষ্যতে দাম আরও বাড়বে তাই বর্তমানে কম দামে কিনে রেখে ভবিষ্যতে অধিক দামে বিক্রয় করতে পারবে, সাবাই তেল কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। কোন পণ্য কেনার চাহিদা বৃদ্ধি পেলে বাকি বিষয় অপরিবর্তীত থাকলে তার দাম বৃদ্ধি পায়। তাই ফটকাবাজরা যেই পণ্য কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তার দাম আকাশে রওনা দেয়।

ছোট থাকতে আপনারা নিশ্চয়ই সাবানের গুঁড়ো পানিতে মিশিয়ে বুদবুদ বানিয়ে খেলেছেন। এই খেলায় সাবানের পানিতে ফুঁ দিলে বুদবুদের ফটকা সৃষ্টি হয় এবং ফুঁ চলতে থাকলে ফটকার আকৃতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তেমনি করে একটি ক্রয়বিক্রয়যোগ্য পণ্য নিয়ে যখন ফটকাবাজদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়, সেই পণ্যের দামও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু এই বৃদ্ধির সাথে অন্তর্নীহিত গুণাবলি, যেমন পণ্যের উপযোগীতা, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইত্যাদির কোন সংযোগ থাকে না। তাই মূল্য বৃদ্ধিও ফটকার মত বাহিরে চাকচিক্যময় কিন্তু ভেতরে অন্তঃসারশূন্য হয়। বাতাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকলে যেমন ফটকার আকৃতি বড় হতে থাকে, ঠিক তেমনি করে নতুন নতুন ক্রেতা ফটকাবাজিতে যুক্ত হতে থাকলে পণ্যের মূল্য আরও বাড়তে থাকে। মূল্য বাড়তেই থাকলে রাতারাতি ধনী হবার আশায় যার যা আছে তাই নিয়ে ফটকাবাজিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। 

এভাবে দাম বাড়তে বাড়তে একসময় বস্তুটি হাতের নাগালের বাহিরে চলে যায়। এ পর্যায়ে সবাই অনুধাবন করতে থাকে যে দাম অতিরিক্ত হয়ে গেছে এবং খুব দ্রুত বিক্রয় করে দেওয়া উচিত। এদিকে সবাই বিক্রির ধান্দায় প্রমাদ গুণতে থাকলে, পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই সচেতন বিক্রেতারা দাম কিছুটা কমিয়ে হলেও হাতের পণ্য থেকে দায় মুক্ত হয়ে যায়। একবার দাম কমা শুরু হলে বাকি ক্রেতাদেরও টনক নড়ে ওঠে। সবাই ভাবতে থাকে এখনি বিক্রয় করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। তাই তারাও হাতের মাল বিক্রয় করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে মার্কেট প্যানিক। একে একে সবাই বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে দেখা যায় এতদিন যারা ক্রেতা ছিল, সব একসাথে বিক্রেতা হয়ে গেছে। তাই পণ্যের দাম ফাটা ফটকার মত এক মুহুর্তে চুপসে যায়। ইংরেজিতে যাকে বলে বাবল বাস্ট। 

স্পেকুলেশনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মুদ্রা বাজারে, শেয়ার বাজারে এবং সোনার বাজারে। তবে যেকোন পণ্য নিয়েই ফটকাবাজি সম্ভব, যেমন আমাদের দেশে ঐতিহাসিক ভাবেই জমি  নিয়ে ফটকাবাজি চলে আসছে। ফটকাবাজির কারণে ঘন ঘন মূল্য পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় আমরা ঝুঁকির পরিমাণ না বুঝেই বিনিয়োগ করি এবং নিজের অজান্তেই ফটকাবাজিতে জড়িত হয়ে পড়ি। এভাবে শেয়ার বা মুদ্রা বাজারে বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারিয়েছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং ফাইনান্সিয়াল বিশেষজ্ঞর সাথে পরামর্শ করে বিনিয়োগের সিধান্ত গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী।  

 তথ্যসূত্র-

https://data.worldbank.org/indicator/NY.GDP.MKTP.CD

https://www.bis.org/publ/qtrpdf/r_qt1912f.htm

https://corporatefinanceinstitute.com/resources/knowledge/trading-investing/speculation/

https://apnews.com/article/c8c2b8e59de340dffa7f6f30f91f3eb5

লেখক

মোহাইমিন পাটোয়ারী

শেয়ার করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *