জীবনের গল্প

অনেকে মনে করে আমি এই বইয়ের বাজার ও লেখালেখি বিশ্লেষণ করে মুদ্রা ও সুদ বিষয়ে বই লিখেছি। কিন্তু একটা কথা কি জানেন? আমি আরিফ আজাদকেও চিনতাম না যখন বই লেখা শেষের দিকে। একদিন একজন আরিফ আজাদের নাম বলাতে আমি বললাম চেনা চেনা লাগছে। সে অবাক হয়ে বলল, “আপনি বই লিখতে চাচ্ছেন। আর ওনাকে চিনেন না? উনি প্যারাডক্সিকাল সাজিদের লেখক।” আমি বললাম, “আচ্ছা, বইয়ের নাম শুনেছি। অনেক বিখ্যাত বই।” এমনকি শক্তি ভাই যেদিন নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে আমার থেকে বই কিনে এবং নিজের বই উপহার দেয়, আমার মন্তব্য ছিল, “ডাক্তার হয়েও বই লিখেন। মাশাল্লাহ।” ওনার আশে পাশের সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।

আমি সত্যি কথা বলতে কিছুই জানতাম না – বই কীভাবে ছাপায়? বড় বড় প্রকাশনীর নাম কি? ইসলামি প্রকাশনী বলে যে আলাদা কিছু আছে ইত্যাদি। বাংলাও লিখতে পারতাম না ঠিক করে। আমার বাংলা হতো অনেকটা ইংরেজি থেকে গুগলে অনুবাদ করার মতন। আর বানান ভুল ছিল অতিরিক্ত। তার কারণ সারাদিন কেবল ইংরেজি বই পড়তাম। ইংরেজি বই নিয়েই পড়ে থাকতাম, বিশেষ করে ক্লাসিক ও একাডেমিক বই। এতো বেশী ইংরেজি পড়েছি যে IELTS এর রিডিং এ যখন ৮.৫ পাই সবাই টিপস নিতে আসলে বিপদে পড়তাম কি বলল। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে অনেকে জানতে চাইতো, “রিডিং এ ভালো করার উপায় কী?” আমি বলতাম, টানা তিন বছর কেবল ইংরেজি পড়েন, ইংরেজিতে চিন্তা করেন, ইংরেজি শোনেন আর মনে করেন এইটাই আপনার ভাষা। ইনশাল্লাহ ভালো করবেন। মানুষ হয়তো মন খারাপ করে চলে যেতো। কিন্তু আমি তো এই কাজই করেছি। সত্যি কথা বলতে কেবল তিন না, তার চেয়ে বহু বেশী সময় করেছি। তবে কথা বলতাম বাংলায় এবং লেখালেখি কখনও পছন্দ করতাম না। সেজন্য আমার স্পিকিং ও রাইটিং ভালো ছিল না। বিদেশে যাবার পর স্পিকিং ভালো হওয়া শুরু করলো। কারণ আমি থাকতাম বিদেশীদের সাথেই। কোন বাংলা কমিউনিটির সাথে ছিলাম না। হোস্টেলে কোন বাঙালি ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশীর সাথেই উঠাবসা করতাম। তাদের সাথেই কোর্স নিতাম। নিকটতম বন্ধুরা বেশিরভাগ ছিল সুইডিশ ও নরওয়েজিয়ান। তার একটা কারণও ছিল। এরা খুব ঠাণ্ডা মাথার ও শান্ত প্রকৃতির। আমার সাথে সেইটা বেশ যেতো। আর তারা অনেক ভদ্রও। উত্তর ইউরোপের, বিশেষ করে নরওয়ের যেই বিষয়টা সবচেয়ে ভালো লেগেছিল তা হচ্ছে সেখানে ভালো মানুষের দাম আছে। আপনি যদি ভালো মানুষ হন, শিক্ষক আপনাকে ভাল জানবে, সহপাঠীরা আপনাকে ভালবাসবে, মেয়েরা আপনাকে পছন্দ করবে ইত্যাদি। আর যদি আপনি খারাপ ব্যক্তি হন, আপনি যত ধনী কিংবা প্রভাবশালী হন লাভ নেই। সবাই আপনাকে এড়িয়ে যাবে। কেউ ভালবাসবে না। সমাজটাই এমন যে মানুষ ভালোর দিকে যায়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে এরা খুব পরিশ্রমী ও সৎ। সেজন্যই তারা উন্নতি করেছে। ব্রিটেন বা আমেরিকার মতন তারা উপনিবেশবাদ বা মুদ্রা ব্যবস্থা দ্বারা সারা বিশ্ব থেকে সম্পদ চুষে নেয় নাই। যা করেছে নিজেরাই করেছে। তাদের দেখলে বুঝবেন যে তারা যোগ্যতা বলেই সব করেছে।

মাঝে মাঝে সেজন্য মনে হয় নরওয়ে থেকে জার্মানি যাওয়া ছিল জীবনের বড় একটা ভুল। আমাকে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করে পাঠিয়েছিল, জার্মানির সেরা বিজনেস স্কুলে। কিন্তু নরওয়ের সাথে আমি আরও ভালো খাপ খাইয়েছিলাম।

যাই হোক, জার্মানিতেও বন্ধু জোগাড় হয়ে যায় এক পর্যায়ে। তাদের সাথেও সারাদিন কথা বার্তা ইংরেজিতে। মায়ের সাথে ছাড়া আর কারো সাথে বাংলাতে কথা হতো না। দেশের সংবাদও পড়তাম না তেমন। ফেসবুকেও দেশের বেশী কিছু আসতো না। সত্যি বলতে আমি নিজেও ফেসবুকে তেমন ঢুকতাম না। ইউরোপে ফেসবুক তেমন পপুলার না। চিন্তার বেশিরভাগ করতাম ইংরেজিতে। আর তার পাশাপাশি জার্মান ও নরওয়েজিয়ান দুই ভাষাই শিখতাম। কিন্তু স্বপ্ন ছিল না সেখানে থাকার। প্রথম কারণ ইসলাম, দ্বিতীয় কারণ সামাজিকতা।

মাঝে মাঝে মনে হয় আল্লাহও চান নাই সেখানে থাকি। কারণ পাশ করার আগে কিছু আবেদন করে দেখেছি কি হয়। মন মতো হয় নাই। তাই যেদিন পরীক্ষা শেষ, তার পরেই চলে আসি দেশে। যদিও চাইলে আরও থাকতে পারতাম এবং চাকরিতে আবেদন করতে পারতাম। বলা যায় ইচ্ছা করেই পরবর্তীতে আর কোনদিন বিদেশে আবেদন করি নাই – চাকরির বা থাকার।

আমি পৃথিবীর যেখানে গিয়েছি মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। স্কুল-কলেজে, আইবিএতে, বিদেশে। তবে দেশে অনেকে আমাকে খোঁচা দিতে চাইতো। বিভিন্ন ভাবে অপমানিত করার চেষ্টা করতো। পরে তাদের অনেকেই স্বীকার করেছে, “তুই মেধাবী দেখে তোকে খোঁচাইতে ও পচাইতে ভালো লাগতো।” ইউরোপে এই দিক থেকে শান্তিতে ছিলাম (এখনও আলহামদুলিলাহ ভালো আছি)। কারণ, সেসব দেশে কেউ ভাল করলে আরেকজন হিংসা করে না। বরং সম্মান করে। অবাক কর বিষয় হচ্ছে ইসলামের অনেক শিক্ষা তাদের মাঝে ছিল। তার একটা কারণ হচ্ছে খ্রিষ্ঠান ধর্ম আল্লাহর থেকে এসেছে এবং সেখানে তাদেরকে একই শিক্ষা দিয়েছে যা আমাদেরকে দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে তারা ঈমান হারিয়েছে।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে সেখানে অনেক মেধাবীদের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি। খুব ভালো লাগতো ক্লাস করতে তাদের সাথে। আমি কঠিন কঠিন কোর্স গুলো নিতাম। আরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করতাম নিজেকে। একদা অত্যন্ত মেধাবী দুইটি মেয়ের সাথে আমার কোর্স পড়ে। স্যার ক্লাসে কঠিন কঠিন সমীকরণ লিখতে থাকতো, গণিতের সূত্র নিয়ে আলোচনা করতো আর দেখি তারা সুন্দর বুঝে যাচ্ছে। আমিও বুঝতাম কিন্তু মাঝে মাঝে তাদের চেয়ে একটু ধীরে। মেয়ে মানুষ এত মেধাবী হয় সেইটা জানা ছিল না আগে – বিশেষ করে গণিতে। আমার একটা স্বভাব ছিল ক্লাসে কেউ বেশী পড়া পারলে তার সাথে মেধার প্রতিযোগিতা করতাম। স্বভাবসুলভ তাদের সাথেও শুরু হয়ে যায়। সমীকরণ যেন আগে বুঝতে পারি। শিক্ষক প্রশ্ন করলে যেন আগে উত্তর দিতে পারি। কয়েক মাস প্রতিযোগিতা করে মনে হলো এদের একজন (সুন্নিভা) আমার চেয়ে এক পা এগিয়ে। সেদিন ইচ্ছা করলো কাঁদি। পরে অবশ্য দুইজন একই গ্রেড পাই। আর এখন মনে করি আমি এক পা এগিয়ে ছিলাম। কারণ সে যেই সুন্দর পরিবেশে সারা জীবন পড়াশোনা করেছে আর আমরা যেই ধরনের শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ পেয়েছি সেই দুইটা এক না। মজার ব্যাপার হচ্ছে শেষ পর্যন্ত কোর্সে আমরা একই গ্রেড পেলাম।

এসেট প্রাইসিং থিওরি ক্লাসে একজন ছেলে ছিলো যাকে দেখলে মনে হতো আমি অশিক্ষিত। তার সাথে কোনদিন প্রতিযোগিতা করি নাই। কারণ কিছু ক্ষেত্রে সারেন্ডার করাটা বুদ্ধিমানের কাজ। এমন আরও অল্প কিছু দেখেছি যাদেরকে দেখলে মনে হতো আমি কিছুই না।

বিদেশ জীবনে আমার সবচেয়ে আনন্দের একটা মুহুর্ত ছিল জার্মানির শেষের দিকে। প্রথম যখন জার্মানি যাই তারা জানালো তাদের ২৫০ জনের মধ্যে মাত্র ৫০ থেকে ৭০ জন ফাইন্যান্স পাবে। আমাকে এদের মধ্যে চান্স পেতে হবে নাইলে অন্য কোন মেজর নিতে হবে। আমার চক্ষু চড়কগাছ। আমি ততদিনে সব পড়াশোনা ফাইন্যান্স ও অর্থনীতি কেন্দ্রিক করেছি। এখন কিভাবে সম্ভব মার্কেটিং বা ম্যানেজমেন্ট বা অন্যকিছু নেওয়া?

তারা আশ্বাস দিল চেষ্টা কর। চেষ্টা করলে পারা সম্ভব। আমার মন খারাপ। সেদিনের মিটিং শেষে আমরা যারা বিদেশ থেকে এসেছি সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে গেলাম। সেদিন পাশে বসেছিল ইতালির মনিকা (সম্প্রতি তার বিয়ে হয়েছে)। সে বলল, “মন খারাপ কেন?” আমি বললাম, “এসে কি ভুল করলাম নাকি। আমি অন্যকিছু পড়তে পারবো না।” সে বলল, “এগুলো নিয়ে চিন্তা করো না”।

আমি চিন্তা করছিলাম অন্য কারণে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল জার্মানি না সারা বিশ্বের সেরা একটি। এখানে প্রায় সব দেশ থেকে ছাত্র ছাত্রীরা পড়তে আসে।  প্রথম সারিতে থাকতে পারবো তো। না পারলে কি হবে?

যাই হোক, সেমিস্টার শেষে দেখলাম ফলাফল বেশ ভালো হলো। তার পরের সেমিস্টারেও ভালো হলো। সব মিলিয়ে ফাইন্যান্সের মধ্যেও প্রথমের দিকে ছিলাম। সেইটা বুঝলাম শিক্ষক দেখে। ফাইন্যান্স এর প্রি থিসিস (সেমিনার) যেই তিনজন শিক্ষক পরিচালনা করেন তাদের মধ্যে আমাদের শিক্ষক সবচেয়ে সামনের দিকের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে এবং কঠিন টপিক নিয়ে ডিল করেন। আমার টপিক পড়লো ডেরাইভেটিভ প্রাইসিং।

আমি ও বুলগেরিয়ার আরেক ছেলে মিলে কাজ শুরু করলাম। ছেলে তো নয় যেন বুলেট। দুইজন মিলে কাজ শেষে আমাদের শিক্ষকের গ্রুপের সবাই একত্রিত হলাম। প্রেসেন্টেশন দিলাম (সত্যিকার অর্থে শেখা যায় এমন প্রেসেন্টেশন)। নিজেরা একে অপরের সাথে কথা বলছিলাম সেদিন। আমরা কাছে মুহুর্তগুলো সত্যি আনন্দের ছিল। কত সুন্দর বোঝা পড়া হচ্ছে সবার সাথে। মিশতেই ভালো লাগে। সবাই কত মেধাবী, কত কিছু জানে। পরদিন সকালে উঠে মনে হতো কখন আবার যাবো।

এবার বলি সবচেয়ে ভালো লাগার মুহুর্ত কখন ছিল। সেই ক্লাসে একসময় আলোচনা উঠলো মুদ্রা (বিশেষ করে বিটকয়েন) নিয়ে। আমাদের সবার সাথে তারা আলোচনা করে করে প্রেসেন্টেশনের দ্বিতীয় অংশ পরিচালনা করছিল অসম্ভব মেধাবী দুই জার্মান যুবক। সেদিন দেখা গেল ক্লাসের সব প্রশ্নের উত্তর এবং আলোচনা আমি একাই করছি। অর্থাৎ, মুদ্রা নিয়ে খুব কম মানুষ জানে এবং এইটা আমার অন্যতম আগ্রহের ব্যাপার হওয়ায় মেধাবীদের ভিড়ে সেরা মেধাবীদের থেকেও বেশী জেনে গেছি। সেদিন যে নিজের উপর কতটা শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোলাগা কাজ করছিল তা বলে বুঝাতে পারবো না। এখনও সেই দিনের কথা চিন্তা করে মনে স্বান্তনা আসে এই বলে যে আমি কিছু বিষয় জানি যা সত্যই মূল্যবান। 

শেয়ার করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *