কুমিরের কামড় ও আমার ছাদ বাগান

কুমিরের কামড়…

ছাত্র ছাত্রী ও বেকার তরুণদের থেকে প্রায়ই আমি এই প্রশ্নটি শুনতাম যে হাতে বিশ ত্রিশ হাজার টাকা আছে। কোন খাতে বিনিয়োগ করব? সত্যি কথা বলতে আমি নিজেই এই সমস্যাতে ছিলাম।

কথায় আছে অভাব হচ্ছে উদ্ভাবনের প্রসূতি। আমার নিজের বেলাতেও ঠিক তাই ঘটলো। পরিবারের ব্যয় কমাতে আমি কিছু গাছ কিনে ছাদে রোপন করে দিলাম। ভাবলাম দ্রুত আমরা এখান থেকে ফল খেতে পারবো। কিন্তু তার চেয়ে দ্রুত বুঝতে পারলাম – ফল ফলানো সহজ কাজ না। দশটা ছোট গাছ থেকে এক মাসে যেই ফল হয় তা দিয়ে সংসার চলা তো দূরে থাক মাসে এক বেলার নাস্তাও হয় না।

এবারে তাই ফলের প্রজেক্ট বাদ দিয়ে ধরলাম তরকারি প্রজেক্ট। কিন্তু বিপদ পড়লো মাটি ও টব সংগ্রহে। একটা হাফ ড্রামের দাম সাতশ টাকা! তা পুরণ করতে মাটির খরচ, গাছ কেনার খরচ, পানি দেওয়ার শ্রম হিসেব করে আমি কাঁদো কাঁদো মন নিয়ে খালি হাতে বাজার থেকে ঘরে ফিরলাম।

ঘরে এসে ফেসবুকে পোস্ট করলাম কারো হাতে টব বা মাটি থাকলে হাদিয়া দিতে পারেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। কেবল একটা চারা গাছ পেলাম যার জন্য টব ও মাটি জোগাড় করার নতুন দায়িত্ব কাঁধে পড়লো।

বাসার মানুষ ভেবেছে আমার শখ বুঝি এখানেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মা ও ভাই জানতো আমি হচ্ছি কুমিরের কামড়। আল্লাহ চাইলে কোন কিছু কামড়ে ধরলে, সহজে নিস্তার নেই।

শুরু করলাম খোঁজ খবর নেওয়া। অনেকে বলল শাক লাগানো লাভ জনক। এদিকে এলাকার বিভিন্ন নার্সারিতে খুঁজে এক বস্তা মাটি সর্বনিম্ন ৬০ টাকায় পেলাম। তার থেকে মাটি আর বিশ টাকা প্যাকেটের শাকের বীজ পাওয়ার পর আশা জাগলো এবারে ভালো কিছু হবে ইনশাল্লাহ।

তারপরে বস্তা কিনে বাসায় এনে শুরু করলাম বীজ বপন করা। এদিকে টবের অভাব পূরণে ফেলে দেওয়া ক্যারেট, শোলা থেকে শুরু করে কিছু ব্যবহার করা বাদ দিলাম না।

ফলে সমীকরণ দাঁড়ালো টবের খরচ শূণ্য, মাটির খরচ বস্তা 60 টাকা, আর সামান্য কিছু বীজ খরচ। (কেউ বস্তা তুলে দিলে বকসিস চাইতে পারে দেখে নিজের হাতেই বস্তা তুলতাম।) কিছুদিনের মধ্যে লাভের মুখ দেখাতে আশা জাগলো প্রজেক্ট আরো বড় করার, কারণ অল্প গাছ বড় করতে যেই শ্রম তাতে পোষায় না।

কিন্তু বাগান বড় করতে গিয়ে পড়লাম নতুন বিপদে। দুই তিন বস্তা বাসায় আনতে প্রায় পঞ্চাশ টাকা রিকশা খরচ লাগে। এবারে তাই নতুন বুদ্ধি বের করলাম, কেউ নার্সারির আশেপাশে কোন কাজে গেলে বলতাম এক দুইটা বস্তা মাটি আনতে। নার্সারি থেকে ওদের লোক রিক্সায় তুলে দিবে। এই ভাবে আবার লাভের মুখ দেখা দিল। পরিবহণ খরচ শূন্য, প্রতি বস্তায় নতুন শাক সবজির ফলন।

ধীরে ধীরে বাসায় ছাদের তরকারি, শাক, তুলসী, থাই পাতা ব্যবহার করতে লাগলাম।

আমার কাজ দেখে স্ত্রী কাঁদো কাঁদো ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি এগুলোই করবেন?”

আমি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “এগুলো খন্ডকালীন কাজ। চিন্তার কিছু নেই।”

যদিও মুখে বললাম, “চিন্তার কিছু নেই।” আমি নিজেই চিন্তা করে দেখলাম প্রায় তিন ঘণ্টা প্রতিদিন ব্যয় করছি ছাদ বাগানের পিছে।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে সারাদিন এগুলো নিয়েই পড়ে আছে। রাস্তাতে দূরে কোথাও যাওয়ার সময় আমি মানুষের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু যেই পরিমাণ শ্রম ও সময় দিচ্ছি তা অন্য খাতে ব্যয় করে সবজি কিনা উত্তম। বলা যায় রিকশা চালকের চেয়েও আমার আয় কম। আধা ঘন্টা রিকশা চালিয়ে কেউ ৮০ টাকা পায়। কিন্তু আমি দিনে দুই তিন ঘন্টা সময় ব্যয় করে মাসে দুই একশ টাকার সবজি পাচ্ছি।

সেই সময় মনকে স্বান্তনা দিলাম, “আমি শিখছি।”

এরপর আমি drip irrigation বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেচের বস্তু কিনলাম, যেন সময় ও শ্রম কম দিতে হয়। কিন্তু সেইটা একটা বাজে বিনিয়োগ ছিল। এইটা দিয়ে ঠিক মতো পানি পড়ছিল না। খুব অল্পই উপকার হলো। সব মিলিয়ে নাজুক অবস্থায় মরার উপর খাড়ার ঘা। বাজারে গিয়ে পাইপ কিনতে গিয়ে অতিরিক্ত দাম দেখে মন খারাপ করে ভাবলাম আরেকটু বেশি দাম দিয়ে drip irrigation কিনে ফেলি তাহলে দুই দিক থেকেই লাভ। কিন্তু এখন দেখি এর ব্যবহার খুব সীমিত, তাই দুই দিক থেকেই লস খেলাম।

এর পর থেকে আবার ভাগ্য বদলাতে থাকে।

একদিন একটি পুরাতন পাইপের ব্যবস্থা হয়ে যায়। মাত্র বিশ মিনিটে আমার পানি দেওয়া শেষ এবং বিকালে অবসর সময়ে হালকা পরিচর্যা করলেই কাজ শেষ।

এই প্রথম সত্যিকার অর্থে আমার ছাদ বাগান লাভজনক হলো।

বিনোদনের উৎস হিসেবে মোবাইল না টিপে দিনে আমি ছাদে সময় ব্যয় করি। এতে ফসল হয়, কৃষি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন হয়, মন ও শরীর ভালো থাকে। সব মিলিয়ে আমার জন্যে ছাদ বাগান একটি লাভজনক প্রজেক্ট হয়ে গেল। আমি তাই সিদ্ধান্ত নিলাম একে আরো অনেক বড় করবো।

কিন্তু নার্সারি থেকে এক-দুই বস্তা মাটি এনে পোষায় না। আমি তাই পাইকারি মাটি কেনার প্রোজেক্ট হাতে নিলাম।কারণ তারা ঘরের সামনে ট্রাকে করে মাটি ফেলে দেয়। এতে আমার বাড়ি পর্যন্ত মাটি পরিবহণ করার খরচ করতে লাগলো না, আবার দামও ভালো পাবো।

কিন্তু কে আমাকে সবচেয়ে কম দামে মাটি দিবে?

এই বিষয়ে খোঁজ নিতে নার্সারি তে গিয়ে দেখলাম তারা মাটি বিক্রেতার নাম্বার দেয় না। বরং তারা কমিশন চায়। তাই বিভিন্ন জন বিভিন্ন দাম বলে। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই বাকি বিল্লা মাহাদীর সাথে যোগাযোগ করলাম। সে ল্যান্ডস্কেপিং ব্যবসা করে। সপ্তাহ খানেক পরে সে সাদ্দাম ভাইয়ের নাম্বার দিল – যিনি আমাকে খুব কম মূল্যে এক ট্রাক মাটি বাসার সামনে এনে দিলেন। ২০০ ঘণ ফুট খোলা মাটি – মাত্র ৫০০০ টাকা। কিন্তু আমার মনে হয় তিনি ২০০ ঘণ ফুটের বেশি মাটি দিয়েছেন।

এদিকে এতো মাটি ছাদে উঠানো নিয়ে পড়লাম আরেক গেড়াকলে। এগুলো জন্য এবারে কিনলাম টবের বিক্লপ জিও ব্যাগ – যার দাম কম কিন্তু গাছ ভালো থাকে। সব মিলিয়ে ফতুর অবস্থা। কর্মী নিয়োগ করে মাটি ছাদে তুলবো সেই টাকাও নেই। তাই প্রতি রাতে এক দুই ঘন্টা করে নিজেই শ্রমিকের মত ছাদে মাটি তুলতে লাগলাম। সাথে আমার ছোট ভাইকেও নিতাম। মাঝে মাঝে তাকে বকশিস দিতাম। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ টন মাটি নিজেরা মিলে তুললাম। কষ্ট লাগলে নিজেকে স্বান্তনা দিতাম এই বলে যে, “মানুষ টাকা দিয়ে জিমে গিয়ে ব্যায়াম করে, আর আমি ব্যায়াম করে টাকা বাঁচাই।”

সব মিলিয়ে ভালোই হয়েছিল। আমার শরীর শক্তিশালী হয়ে উঠে। এখন কাজ করতে আরও আত্মবিশ্বাস পাই। নিজেকে আরও পৌরুষত্বপূর্ণ লাগে।

এখন এক দেড় ঘন্টার মধ্যেই ছাদ বাগানের কাজ হয়ে যায়। তবে এর পিছে সময় নষ্ট করি না। লিখতে লিখতে যখন ক্লান্ত লেগে উঠে ছাদে গিয়ে গাছের সাথে সময় ব্যয় করি। নিজের কাছে ভালো লাগে এবং গত এক মাস যাবত বাসাতে প্রতি বেলা ছাদের থেকে এক তরকারির যোগান হচ্ছে। পাঁচ জনের পরিবারের দুই বেলার জন্য এক তরকারি মানে দশ জনের এক বেলার তরকারি আমি ছাদ থেকে পাচ্ছি। এখন যেই গাছগুলো ছোট আছে সেগুলো বড় হলে আশা করি ফলন আরও বৃদ্ধি পাবে ইনশাল্লাহ।

কঠোর পরিশ্রম কঠিন কাজকে সহজ করে দেয়। কুমিরের কামড় গল্পটির দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব সমাপ্ত হলো। এখন আপনিই ভাবেন, বিশ হাজার টাকা ব্যাংকে রাখবেন নাকি ছাদ বাগান করবেন? আল্লাহ যদি থাকে সাথে, পা বাড়াতে ভয় কি?

মোহাইমিন পাটোয়ারী

শেয়ার করুন

1 thought on “কুমিরের কামড় ও আমার ছাদ বাগান”

  1. Pingback: লেখালেখির হাতে খড়ি - মোহাইমিন পাটোয়ারী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *